সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১২

মুক্তির মন্দির সোপান তলে...


প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে দিনের কাজ শুরু করি। কাগজে কী দেখি- পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, ফ্লাইওভার ধ্বসে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি, দুই শীর্ষনেত্রীর পারস্পরিক তর্কযুদ্ধ- কাদা ছোড়াছুড়ি, প্রকল্পে দুর্নীতি, পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ-সমাবেশ, পুলিশের রণপ্রস্তুতি এরপর হরতাল-পিকেটিং-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ-গ্রেপ্তার- এমনি নানা দুঃসংবাদ, আঘাত-প্রতিঘাতের ধ্বংসকাব্যে ঠাসা প্রতিদিনের কাগজের পাতা। ভীতি, অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনায় ঘেরা তাই প্রতিটি সকাল। কখনো কখনো ভাবি- একটু আলো কিংবা ভালোর ঠিকানা বুঝি কাগজওয়ালাদের জানা নেই।
এত কিছুর মধ্যেও প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস এলে আমরা ‘বিজয়’ এর কথা ভাবি। বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা- শব্দগুলো আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে নতুন দ্যোতনা নিয়ে। আনন্দে উদ্বেল হয়ে কিংবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে আমরা গেয়ে উঠি বিজয়ের গান- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল... মুক্তির মন্দির সোপান তলে...।
হ্যাঁ, এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৪১ বছর কেটে গেছে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সর্বত্র আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সময়ের সঙ্গে আমরা অনেকখানি বদলে গেছি। তবু ডিসেম্বর মাস এলে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠে- শৃঙ্খল মুক্তির যে দুর্বার শপথে একাত্তরে আমরা জীবনবাজি রেখেছিলাম, ত্যাগ করেছিলাম নিজের সর্বস্ব; সেই লক্ষ আদৌ অর্জিত হয়েছে কি? আমরা কি পেয়েছি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক মুক্তি, জীবনের স্বাভাবিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি? আমাদের সার্বিক অবস্থান আজ কোথায়? আমরা কি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি? পরনির্ভরতা আর বিদেশি ঋণের বোঝা কেন আমাদের কাঁধে চেপে আছে? সার্বিক দুরবস্থার উত্তরণের আকাক্সক্ষা আমাদের মধ্যে আছে কি? নাকি রাজনীতির নামে আমরা কেবল হানাহানি, স্বার্থলিপ্সা, আত্মচিন্তা আর সংঘাতে লিপ্ত থেকেছি? 

পাখির ভিড়ে


গাছের ডালে টুনটুনিরা
ডাকে মধুর সুরে
কোকিল পাখির মিষ্টি গানে
ঘুম ভেঙে যায় ভোরে।
বাইরে দেখি বন-বাগানের
সবুজ গাছে গাছে
নাম না-জানা হাজার পাখি
গান করে আর নাচে।
স্বাধীন পাখি নীল আকাশে
ডানা মেলে উড়ে
কেউ বা আবার গানের পাখি
মারে বুলেট ছুঁড়ে।
সন্ধে হলে সকল পাখি
ফিরে আপন নীড়ে
আমার ভীষণ ইচ্ছে করে
হারাই ওদের ভিড়ে।

বৃষ্টি নামের বোনটি আমার



ছয় বছরের বোনটি আমার
নাম হলো তার বৃষ্টি
এক-দুটো নয় একসাথে সে
চায় চকোলেট বিশটি।

হয় সে খুশি যখন নামে
রিমঝিমিয়ে বিষ্টি
চাঁদ-তারা-মেঘ ফুল-পাখিরাও
আমার বোনের ইষ্টি।

মনের মতো খেলনা পেলে
দেয় সে হেসে মিষ্টি
তার প্রতি রয় সদাই আমার
ভালোবাসার দিষ্টি।

বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১২

রূপসী নীল অপরাজিতা

লাল, সাদা, বেগুনি, নীল, গোলাপি এমনি আরো কত রঙে রঙিন আমাদের পুষ্প-নিসর্গ! এর মধ্যে নীল ফুলের কথা যদি বলি- প্রথমেই আসে রূপসী অপরাজিতার নাম। লতানো গাছে সবুজপাতার কোলে এক টুকরো প্রগাঢ় নীলের সম্ভাষণ আপনার ভাললাগার অনুভূতিকে নিমেষে ছুঁয়ে যাবে। ফুলে কোনো গন্ধ নেই, তবু রঙের বাহার আর মিষ্টি শোভায় অনন্য সে অপরাজিতা।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, অপরাজিতা গুচ্ছে ফোটে না। পাতাভর্তি লতার ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফুল ফোটে, যেন এরা একা থাকতে ভালবাসে। আর তাতে আপনার ভাবুক মন আনমনে গেয়ে উঠতে পারে নজরুলের গান:

আমি বিজন বনের অপরাজিতা
আমার কথা কহি গানে......। 
গাঢ় নীল ফুলটিকে ডাকা হয় নীলকণ্ঠ নামেও। নীল ছাড়াও চোখে পড়ে সাদা এবং হালকা বেগুনি রঙের ফুল। ফুলের ভেতরের দিকটা সাদা বা ঈষৎ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। বাড়ির আঙিনায়, টবে বা বাগানে সাধারণত এ গাছ লাগানো হয়। দেখা যায় বুনো অপরাজিতাও। আশেপাশের উঁচু গাছ বেয়ে এটি তরতর করে বেড়ে ওঠে, ফুলে-পাতায় বিকশিত হয়। হালকা সবুজ রঙের পাতার গড়ন উপবৃত্তাকার। ঝোপজাতীয় গাছে প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে। বহুবর্ষজীবী এ লতা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
অপরাজিতার বৈজ্ঞানিক নাম ক্লাইটোরিয়া টের্নাটেয়া (Clitoria ternatea). ক্লাইটোরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক ক্লেটোরিস থেকে, ফুলের আকার বোঝানোর জন্য। আর টের্নাটেয়া এসেছে ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা উপসাগরের টের্নাট দ্বীপের নামানুসারে, যেখান থেকে এই ফুলটি সংগ্রহ ও নামকরণ করা হয়। ইংরেজি নাম বাটারফ্লাই পি বা ব্লু পি।
কেবল সৌন্দর্যে নয়, ওষুধি গুণেও অতুলনীয় অপরাজিতা। এর ফুল, পাপড়ি, মূল ও গাছের লতা নানা ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার্য। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অপরাজিতা পবিত্র উদ্ভিদ। শারদীয় দুর্গোৎসবে ষষ্ঠীতে এবং বিজয়া দশমীর পুজোয় এ ফুল ব্যবহারের প্রচলন আছে। রূপকথার গল্পেও আছে অপরাজিতার নাম, পরিদের কাছে আংটি হিসেবে ছিল ফুলটির ব্যবহার। 
ঢাকায় রমনা পার্ক, শিশু একাডেমীর বাগান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকাসহ বিভিন্ন বাগানে অপরাজিতা ফুলের দেখা মেলে। ঢাকার যাপিত জীবনে সবুজের দীনতা এবং জায়গার স্বল্পতায় ছাদবাগানে এবং টবে অপরাজিতা গাছ লাগানো যেতে পারে।

ছবির ক্যাপশন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের বাগানে অপরাজিতা ফুল  >> লেখক

লাল রঙ্গনে ভরা অঙ্গন

বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত তার রূপ বদল করে। সময়ের পালাবদলে গ্রীষ্ম, বর্ষা থেকে বসন্ত_ ছয়টি ঋতুভেদে প্রকৃতি নিজেকে গড়ে নেয় আপন রূপে, নতুন সাজে। ফুলে-ফলে, পত্র, বৃক্ষ-তরুলতায় প্রকাশ পায় এই পরিবর্তন, নতুনের স্পন্দন। আবার বছরব্যাপী প্রকৃতিতে চেনা রঙে, একই ঢঙে বিরাজ করে এমন অনুষঙ্গও বিরল নয়। আমাদের পুষ্প-উদ্যানে সারা বছর সুরভি ছড়ানো ফুলের মধ্যে একটি হলো 'রঙ্গন'। সবুজ পাতার কোলে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল ফুলের সৌন্দর্য বড়ই দৃষ্টিনন্দন। বাংলাদেশের প্রায় সব বাগানে রঙ্গনের দেখা মেলে। আকর্ষণীয় সৌন্দর্যে, বর্ণবৈচিত্র্যে রঙ্গন বাগানের শোভা বৃদ্ধি করে।
ঘনবিন্যস্ত পাতার কোলে গাঢ় লাল রঙের পুষ্পমঞ্জরিতে অসংখ্য ফুলের সমারোহ কার না দৃষ্টি কাড়ে! রঙ্গন ফুল আকারে ছোট, নলাকৃতি। তারার মতো চারটি পাপড়ির বিন্যাসে অনুপম রঙ্গনের মাধুর্য। বিশেষ করে, থোকায় থোকায় সদ্য ফোটা লাল ফুলের উচ্ছ্বাস পুষ্পপ্রেমীর মনে জাগায় ভালোলাগার এক অপার্থিব অনুভূতি।
বাগানে সাধারণত লাল রঙের ফুলই বেশি দেখা যায়। লাল ছাড়াও রঙ্গন গোলাপি, হলুদ ও সাদা রঙের হয়ে থাকে। রঙ্গনগাছ আকারে ছোটখাটো, ঝোপজাতীয়, ডালপালাগুলো লতানো। ঘন চিরসবুজ পত্রনিবিড় এ গাছ দুই থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ঢাকায় শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, পান্থপথের পান্থকুঞ্জ, কার্জন হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রঙ্গন চোখে পড়ে। বাগান ছাড়াও বাড়ির আঙিনা, সড়কদ্বীপ ও সড়ক-বিভাজকে রঙ্গনগাছ লাগাতে দেখা যায়।
লাল রঙের রঙ্গন ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম 'ইক্সোরা কক্সিনিয়া' (Ixora coccinia)। এটি মূলত এশীয় অঞ্চলের প্রজাতি। সহজেই এর চাষ করা যায়। পরিণত গাছের ডাল নিচ থেকে কেটে রোপণ করে নিয়মিত যত্ন নিলে শিকড় গজায়। এ ছাড়া কলম করেও বংশবিস্তার করা যায়।
প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে বলে রঙ্গন বাগানের বর্ণবৈচিত্র্যে এক ভিন্ন সুষমা যোগ করে। তাই পুষ্প-নিসর্গের শোভাবর্ধনে পরিকল্পিত রঙ্গনবীথি গড়ে তোলা যেতে পারে। 
(০৬ নভেম্বর, ২০১২ দৈনিক সমকাল-এ প্রকাশিত) 

হেমন্তের শোভা হিমঝুরি

এই হেমন্তে আপনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের ফটকে গিয়ে দাঁড়ান, ঘন সবুজ পাতাময়, আকাশছোঁয়া একটি গাছ আপনার চোখে পড়বে। গাছের তলায় দেখবেন ঝরা ফুলের মেলা। বিশেষ করে, সাতসকালের হিম বাতাসে সাদা ফুলের প্রাচুর্য, সঙ্গে মিষ্টি সুরভি আপনাকে আকুল করবে মুহূর্তেই। একটু অপেক্ষা করলে পেতে পারেন বাতাসের স্পর্শে ঝরতে থাকা গুঁড়ি গুঁড়ি ফুলের সম্ভাষণও।
বলছি হিমঝুরির কথা। হিমের দিনে সাদা হিমের মতোই যেন ফুলগুলো ঝরে পড়ে। সৌন্দর্য-মুগ্ধ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই একে ডেকেছেন হিমঝুরি নামে। হিমঝুরি রাতে ফোটে এবং গন্ধ বিলোয়।
হিমঝুরি (Millingtonia hortensis) সুউচ্চ, লম্বাটে ধরনের চিরসবুজ গাছ। ২০০ বছরেরও আগে মিয়ানমার থেকে এসে এটি আমাদের উদ্যানে জায়গা করে নিয়েছে। এই গাছের ডালপালাগুলো ছড়ানো-ছিটানো, আগা নিচের দিকে নুয়ে থাকে। ডালের মাথায় অসংখ্য মঞ্জরিতে
বিক্ষিপ্তভাবে ফুল ফোটে। নলাকার সাদা ফুলের মাথায় পাঁচটি ছোট পাপড়ির একেকটি ফুল শুভ্র পাপড়ির মতো। আর নিচের দিকে ঝুলে থাকা ফুলগুলো বাতাসের পরশে যেন নেচে ওঠে বারবার। সরু, লম্বা ফুল এক ফুট বা তারও বেশি বড় হয়। এর বীজ হালকা ও পাখাযুক্ত বলে বায়ুর মাধ্যমে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। হিমঝুরি গাছ ছায়াঘন নয় বলে রাস্তার ধারে লাগানোর অনুপযুক্ত। কাঠ হালকা ও মসৃণ, আসবাব তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। নিমগাছের সঙ্গে সাদৃশ্য এবং বলিষ্ঠ উচ্চতার জন্য হিমঝুরি আকাশনিম নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম 'ইন্ডিয়ান কর্ক ট্রি'।
মাধুর্যে, কমনীয়তায় অপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও গাছটি ঢাকায় বেশ দুষ্প্রাপ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের সামনের গাছটি ছাড়া শিশু একাডেমীর বাগান এবং বলধা গার্ডেনসংলগ্ন খ্রিস্টান কবরস্থানে কয়েকটি গাছ চোখে পড়ে। হেমন্তের শিশির-ভেজা প্রকৃতিতে ফুলের সংখ্যা অনেকটা সীমিত। তাই আমাদের উদ্যানের বৈচিত্র্য ও শোভাবর্ধনে এ গাছের অধিকতর বিস্তার হওয়া দরকার। রূপে-গন্ধে-সৌন্দর্যে অতুলনীয় হিমঝুরির প্রাচুর্য হৈমন্তিক পুষ্প-নিসর্গে নতুন মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। 

             (২০ নভেম্বর, ২০১২ দৈনিক সমকাল-এ প্রকাশিত)

অর্কিড কাঞ্চনে মুগ্ধতা

পৌষের এক কুয়াশামোড়ানো সকালে প্রকৃতির একটু সবুজ ছোঁয়া পেতে গিয়েছিলাম রাজধানীর রমনা পার্কে। শীতের চাদর ফুঁড়ে এক চিলতে রোদের ঝিলিক ভারী মিষ্টি ...