অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা একাধারে শিক্ষক,অনুবাদক ও লেখক। নিসর্গ ও পরিবেশের জন্য জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন। ছেলেবেলার সুবর্ণ সময় কাটিয়েছেন জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে। শিক্ষকতা করেছেন বরিশাল বিএম কলেজ এবং নটরডেম কলেজে। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের কাজ করেছেন প্রায় বিশ বছর। দেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে। বাংলা একাডেমী পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ সংকট, এর সংরক্ষণে করণীয়, বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবী ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে সম্প্রতি তার সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন জাহিদ রুমান। আলাপনের চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো:
প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, বলতে গেলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন। প্রথমে জানতে চাই, প্রকৃতির প্রতি আপনি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?
এই প্রশ্নটি আমাকে বহুবার করা হয়েছে এবং আমি নানাভাবে জবাব দিয়েছি। এখন আমার কাছে মনে হয়, ব্যাপারটা একটু জটিল। ইদানীং এপিজেনিটিক্স বলে নতুন একটি বিজ্ঞানধারার উদ্ভব ঘটেছে। এতে মনে করা হয়, আমরা যা ‘হয়ে উঠি’ তার মূলে জিনের ভূমিকা আছে, লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচনে যেটা গড়ে উঠেছে। জেনেটিক্স বা বংশগতি থেকে আমরা যা পাই সেটা হলো ‘সহজাত প্রবৃত্তি’। আর বাকিটা এপিজেনিটিক্যাল সিস্টেম বা উপবংশগতি থেকে গড়ে ওঠে।
আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে গাছপালা ছিল। আমার বাবা গাছ লাগাতে উৎসাহী ছিলেন। আমার ভাই-বোন সকলেই এসব দেখেছে। কিন্তু সবাই আমার মতো প্রভাবিত হয়নি। আমি যে হয়েছি এটা এপিজেনেটিকেল সিস্টেমের কোনো জটিল নিয়মেই ঘটেছে। হ্যাঁ, আমি ছোটবেলা থেকে গাছপালা, জীবজন্তু খুবই ভালোবাসি, বিশেষ করে পাখি। ছেলেবেলায় হাঁড়িচাচা, হলদে পাখির সৌন্দর্য আমাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে রাখত।
প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছেন কবে থেকে? আপনার লেখালেখির ইতিবৃত্ত জানতে চাই...
প্রকৃতির প্রতি ভালো লাগার বোধ থেকে এ নিয়ে আমি লেখালেখি শুরু করি। রমনা পার্ক তখনও বৃক্ষশোভিত হয়নি। ছাত্রজীবনে রমনা গ্রিনে আমরা ঘুরে বেড়াতাম, জায়গাটা খুব ভালো লাগত। রমনা গ্রিনের সৌন্দর্য আমাকে ঢাকার গাছ নিয়ে একটি বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। কাগজে লেখালেখির পাশাপাশি বই লেখাও শুরু করি। বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৮১ সালে ‘শ্যামলী নিসর্গ’ নামে এটি প্রকাশিত হয়। তারপর আমি এ ধারার লেখার প্রতি আকৃষ্ট হই। প্রথম দিকে আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে লিখি। সময়ের সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক, পরিবেশ সংকটও আমার লেখার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে পাঁচটিসহ এ পর্যন্ত আমার গোটা ১৬টি বই বেরিয়েছে। এখনও আমি লিখি এবং এটিই আমার লেখার প্রধান বিষয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আপনি এই উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিত। আমাদের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেন আমার প্রত্যাশার সঙ্গে মেলেনি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মূল কাজ গবেষণা; বিজ্ঞান ও শিক্ষার মেলবন্ধন, বিনোদন নয়। কিন্তু আমাদের এখানে কিছুটা বিনোদন ছাড়া তেমন কোনো কাজই হয়নি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাঠামোয় হার্বেরিয়াম থাকবে কেন্দ্রে, সেই সঙ্গে দেশের সমস্ত উদ্ভিদের তালিকা প্রণয়ন, নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিপন্ন উদ্ভিদ রক্ষা ইত্যাদি। গবেষণাগার থাকবে যেখানে উদ্ভিদের নানা ভ্যারাইটি উদ্ভাবিত হবে। অনুদানের স্বল্পতা ও বনবিভাগের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। ট্যাক্সোনমিস্ট ও উদ্যানতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে বোটানিক্যাল গার্ডেন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত।
আমাদের চিড়িয়াখানার কথা যদি বলি। প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণে চিডিয়াখানা কতটুকু ভূমিকা রাখছে?
সেখানেও একই অবস্থা। ‘জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যেটা দেশের জীবজন্তু শনাক্তি, প্রজাতির অবস্থা, সংখ্যা ও অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রকৃতিবিদরা এককভাবে কাজ করছেন। বেসরকারি সংগঠন এবং ব্যক্তি-উদ্যোগে পাখি দেখাসহ নানা আয়োজন হয়। তাদের মাধ্যমে জীবজগতের খবর আমরা অনেকটা জানতে পারি।
আমাদের দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণির পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা কি হয়েছে?
হয়েছে। এ বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। তারা প্রথমে বের করে বাংলাপিডিয়া। পরে জীবজগৎ নিয়ে আলাদা কাজ হয়েছে। নানা উত্থান-পতন ও সংকট অতিক্রম করে বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষায় ২৮ খণ্ড করে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। বাংলাটা আমাদের সকলের জন্য আর ইংরেজিটা পৃথিবীর বিশেষজ্ঞদের জন্য। কারণ, বাংলাদেশের জীবসম্পদ পৃথিবীর জীবসম্পদেরই অংশ।
আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ সংকটের পূর্বাপর সম্পর্কে কিছু কথা...
প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে জীবজগতের মধ্যে একটা নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। তাদের নিজেদের সঙ্গে, অন্য প্রজাতির সঙ্গে এমনকি জড়জগতের সঙ্গেও লড়াই চলছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতির একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছি। এতটাই শক্তি আমরা অর্জন করেছি যে ইচ্ছে করলে পৃথিবীকে আমরা মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারি, কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা আরেকটা পৃথিবী বানাতে পারি না।
আমরা জানি, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বাড়ার ফলে প্রতিনিয়ত ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এতে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে আসছে যা জীবজগতের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ার ফলে সাগরজলের স্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। সাগরের উপরিভাগ উঁচু হচ্ছে, এতে আমাদের নিম্নাঞ্চল ডুবে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, খরা-বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক নিয়ম বদলে যাচ্ছে।
আমরা যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাতে চাই সেটাও আমাদের আয়ত্তে নেই। কতগুলো বৈশ্বিক সম্মেলন হয়ে গেলেও কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যাচ্ছে না। কারণ, ঐক্যমতে পৌঁছাতে হলে দূষণমুক্ত নতুন শিল্প দরকার। আবার, কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমালে আমাদের শিল্পোৎপাদন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ, প্রতিবেশের যে সাংঘর্ষিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছে তা নিরসনের উপায় আমরা জানি না।
পরিবেশ সংকটের বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে কিছু কথা.....
বাংলাদেশ তো পৃথিবীর বাইরে নয়, তাই বৈশ্বিক সংকটের ঝাপটা আমাদের এখানেও লাগবে। বাংলাদশের জন্য বিশেষ যে সংকট তা হল, জায়গাটা খুব ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। এখানে যে কোনো রকমের উন্নয়নেই পরিবেশ কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দূষণ বাড়বে।
সরকারের ভুল পরিকল্পনায় এখন বলতে গেলে তেমন কোনো বনই অটুট নেই। আমাদের নদী, হাওরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে নদীর স্রোত কমে লবণাক্ত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে। এভাবে সারা দেশ জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সবমিলিয়ে আমাদের সামনে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন কতটা সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে?
আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন আমার কাছে প্রসাধনমূলক মনে হয়। কারণ এটা কয়েকটা শহরে মূলত ঢাকায় সীমাবদ্ধ। এতে কার্যকর কিছু হবে না। এ আন্দোলন গ্রাম পর্যায়ে প্রসারিত করতে হবে। গ্রামীণ মানুষকে পরিবেশ সচেতনতা শিক্ষা দিতে হবে। প্রকৃতি সংরক্ষণ ও পরিপোষক উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। কাজের মধ্য দিয়ে এ বার্তা যদি জনগণের কাছে পৌছানো না যায় তাহলে কীভাবে প্রকৃতি রক্ষা সম্ভব হবে?
প্রকৃতি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগের কার্যকারিতা কতটুকু?
সীমাবদ্ধতার কথা আগেই বললাম। সরকারের কাজ মানুষের খাদ্য যোগান, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা। এসব করতে গেলে শিল্পায়ন অপরিহার্য। অতএব সরকার উন্নয়নের জন্য শিল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তা না করে উপায়ও নেই। আবার শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ বিনাশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সরকার আইন করেছে, বিভিন্ন জায়গায় অভয়ারণ্য বানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এ আইনের প্রয়োগ কোথায়? নীতিনির্ধারকমহলও এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহী নয়। সবমিলিয়ে আমরা একটা গোঁজামিল, হতাশার চিত্র দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের প্রচলিত পর্যটনের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমাদের পর্যটন, পরিবেশবিরোধী ও ধ্বংসাত্মক বাণিজ্য। বিনোদনের যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় যে অল্প কয়েকটি প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে সেগুলো আমরা নষ্ট করছি। পর্যটন খুবই প্রয়োজন, কিন্তু তা হবে তীর্থদর্শনের মতো-নীরবে, শান্তভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী?
আমাদের আগের আলোচনায় এটা খুব স্পষ্ট হয়েছে যে- মানুষের ভবিষ্যৎ বিপন্ন। মানুষ যদি পরিবেশবান্ধব শিল্প এবং কৃষি উদ্ভাবন করতে না পারে এবং জনসংখ্যা হ্রাস ও সমাজে শোষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারে তাহলে পৃথিবী একদিন বসবাসযোগ্য থাকবে না।
আপনি মহাবিপর্যয়ের কথা বলছেন। এই মুহূর্তে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু কি নেই?
আশাবাদ তো থাকবেই। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ একদিন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। যে সংকট মানুষ সৃষ্টি করেছে তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পথ’ সে খুঁজে পাবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা দেখে খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না। সবসময় একটা বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃতি ধ্বংসের আশঙ্কাও আমরা দেখি। কারণ, পরিবেশবান্ধব শিল্পের বিকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, বলতে গেলে গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন। প্রথমে জানতে চাই, প্রকৃতির প্রতি আপনি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?
এই প্রশ্নটি আমাকে বহুবার করা হয়েছে এবং আমি নানাভাবে জবাব দিয়েছি। এখন আমার কাছে মনে হয়, ব্যাপারটা একটু জটিল। ইদানীং এপিজেনিটিক্স বলে নতুন একটি বিজ্ঞানধারার উদ্ভব ঘটেছে। এতে মনে করা হয়, আমরা যা ‘হয়ে উঠি’ তার মূলে জিনের ভূমিকা আছে, লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচনে যেটা গড়ে উঠেছে। জেনেটিক্স বা বংশগতি থেকে আমরা যা পাই সেটা হলো ‘সহজাত প্রবৃত্তি’। আর বাকিটা এপিজেনিটিক্যাল সিস্টেম বা উপবংশগতি থেকে গড়ে ওঠে।
আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে গাছপালা ছিল। আমার বাবা গাছ লাগাতে উৎসাহী ছিলেন। আমার ভাই-বোন সকলেই এসব দেখেছে। কিন্তু সবাই আমার মতো প্রভাবিত হয়নি। আমি যে হয়েছি এটা এপিজেনেটিকেল সিস্টেমের কোনো জটিল নিয়মেই ঘটেছে। হ্যাঁ, আমি ছোটবেলা থেকে গাছপালা, জীবজন্তু খুবই ভালোবাসি, বিশেষ করে পাখি। ছেলেবেলায় হাঁড়িচাচা, হলদে পাখির সৌন্দর্য আমাকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করে রাখত।
প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছেন কবে থেকে? আপনার লেখালেখির ইতিবৃত্ত জানতে চাই...
প্রকৃতির প্রতি ভালো লাগার বোধ থেকে এ নিয়ে আমি লেখালেখি শুরু করি। রমনা পার্ক তখনও বৃক্ষশোভিত হয়নি। ছাত্রজীবনে রমনা গ্রিনে আমরা ঘুরে বেড়াতাম, জায়গাটা খুব ভালো লাগত। রমনা গ্রিনের সৌন্দর্য আমাকে ঢাকার গাছ নিয়ে একটি বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। কাগজে লেখালেখির পাশাপাশি বই লেখাও শুরু করি। বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৮১ সালে ‘শ্যামলী নিসর্গ’ নামে এটি প্রকাশিত হয়। তারপর আমি এ ধারার লেখার প্রতি আকৃষ্ট হই। প্রথম দিকে আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে লিখি। সময়ের সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক, পরিবেশ সংকটও আমার লেখার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে পাঁচটিসহ এ পর্যন্ত আমার গোটা ১৬টি বই বেরিয়েছে। এখনও আমি লিখি এবং এটিই আমার লেখার প্রধান বিষয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আপনি এই উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিত। আমাদের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেন আমার প্রত্যাশার সঙ্গে মেলেনি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মূল কাজ গবেষণা; বিজ্ঞান ও শিক্ষার মেলবন্ধন, বিনোদন নয়। কিন্তু আমাদের এখানে কিছুটা বিনোদন ছাড়া তেমন কোনো কাজই হয়নি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাঠামোয় হার্বেরিয়াম থাকবে কেন্দ্রে, সেই সঙ্গে দেশের সমস্ত উদ্ভিদের তালিকা প্রণয়ন, নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিপন্ন উদ্ভিদ রক্ষা ইত্যাদি। গবেষণাগার থাকবে যেখানে উদ্ভিদের নানা ভ্যারাইটি উদ্ভাবিত হবে। অনুদানের স্বল্পতা ও বনবিভাগের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। ট্যাক্সোনমিস্ট ও উদ্যানতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে বোটানিক্যাল গার্ডেন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত।
আমাদের চিড়িয়াখানার কথা যদি বলি। প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণে চিডিয়াখানা কতটুকু ভূমিকা রাখছে?
সেখানেও একই অবস্থা। ‘জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যেটা দেশের জীবজন্তু শনাক্তি, প্রজাতির অবস্থা, সংখ্যা ও অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রকৃতিবিদরা এককভাবে কাজ করছেন। বেসরকারি সংগঠন এবং ব্যক্তি-উদ্যোগে পাখি দেখাসহ নানা আয়োজন হয়। তাদের মাধ্যমে জীবজগতের খবর আমরা অনেকটা জানতে পারি।
আমাদের দেশের উদ্ভিদ ও প্রাণির পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা কি হয়েছে?
হয়েছে। এ বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। তারা প্রথমে বের করে বাংলাপিডিয়া। পরে জীবজগৎ নিয়ে আলাদা কাজ হয়েছে। নানা উত্থান-পতন ও সংকট অতিক্রম করে বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষায় ২৮ খণ্ড করে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। বাংলাটা আমাদের সকলের জন্য আর ইংরেজিটা পৃথিবীর বিশেষজ্ঞদের জন্য। কারণ, বাংলাদেশের জীবসম্পদ পৃথিবীর জীবসম্পদেরই অংশ।
আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ সংকটের পূর্বাপর সম্পর্কে কিছু কথা...
প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে জীবজগতের মধ্যে একটা নিরন্তর সংগ্রাম চলছে। তাদের নিজেদের সঙ্গে, অন্য প্রজাতির সঙ্গে এমনকি জড়জগতের সঙ্গেও লড়াই চলছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতির একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছি। এতটাই শক্তি আমরা অর্জন করেছি যে ইচ্ছে করলে পৃথিবীকে আমরা মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিতে পারি, কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা আরেকটা পৃথিবী বানাতে পারি না।
আমরা জানি, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বাড়ার ফলে প্রতিনিয়ত ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এতে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে আসছে যা জীবজগতের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ার ফলে সাগরজলের স্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। সাগরের উপরিভাগ উঁচু হচ্ছে, এতে আমাদের নিম্নাঞ্চল ডুবে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, খরা-বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক নিয়ম বদলে যাচ্ছে।
আমরা যদি কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমাতে চাই সেটাও আমাদের আয়ত্তে নেই। কতগুলো বৈশ্বিক সম্মেলন হয়ে গেলেও কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যাচ্ছে না। কারণ, ঐক্যমতে পৌঁছাতে হলে দূষণমুক্ত নতুন শিল্প দরকার। আবার, কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমালে আমাদের শিল্পোৎপাদন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ, প্রতিবেশের যে সাংঘর্ষিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছে তা নিরসনের উপায় আমরা জানি না।
পরিবেশ সংকটের বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে কিছু কথা.....
বাংলাদেশ তো পৃথিবীর বাইরে নয়, তাই বৈশ্বিক সংকটের ঝাপটা আমাদের এখানেও লাগবে। বাংলাদশের জন্য বিশেষ যে সংকট তা হল, জায়গাটা খুব ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। এখানে যে কোনো রকমের উন্নয়নেই পরিবেশ কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দূষণ বাড়বে।
সরকারের ভুল পরিকল্পনায় এখন বলতে গেলে তেমন কোনো বনই অটুট নেই। আমাদের নদী, হাওরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে নদীর স্রোত কমে লবণাক্ত পানি ভেতরে প্রবেশ করছে। এভাবে সারা দেশ জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সবমিলিয়ে আমাদের সামনে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন কতটা সফলতার মুখ দেখতে পেরেছে?
আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলন আমার কাছে প্রসাধনমূলক মনে হয়। কারণ এটা কয়েকটা শহরে মূলত ঢাকায় সীমাবদ্ধ। এতে কার্যকর কিছু হবে না। এ আন্দোলন গ্রাম পর্যায়ে প্রসারিত করতে হবে। গ্রামীণ মানুষকে পরিবেশ সচেতনতা শিক্ষা দিতে হবে। প্রকৃতি সংরক্ষণ ও পরিপোষক উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। কাজের মধ্য দিয়ে এ বার্তা যদি জনগণের কাছে পৌছানো না যায় তাহলে কীভাবে প্রকৃতি রক্ষা সম্ভব হবে?
প্রকৃতি সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগের কার্যকারিতা কতটুকু?
সীমাবদ্ধতার কথা আগেই বললাম। সরকারের কাজ মানুষের খাদ্য যোগান, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা। এসব করতে গেলে শিল্পায়ন অপরিহার্য। অতএব সরকার উন্নয়নের জন্য শিল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তা না করে উপায়ও নেই। আবার শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ বিনাশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সরকার আইন করেছে, বিভিন্ন জায়গায় অভয়ারণ্য বানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এ আইনের প্রয়োগ কোথায়? নীতিনির্ধারকমহলও এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহী নয়। সবমিলিয়ে আমরা একটা গোঁজামিল, হতাশার চিত্র দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের প্রচলিত পর্যটনের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমাদের পর্যটন, পরিবেশবিরোধী ও ধ্বংসাত্মক বাণিজ্য। বিনোদনের যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় যে অল্প কয়েকটি প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে সেগুলো আমরা নষ্ট করছি। পর্যটন খুবই প্রয়োজন, কিন্তু তা হবে তীর্থদর্শনের মতো-নীরবে, শান্তভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী?
আমাদের আগের আলোচনায় এটা খুব স্পষ্ট হয়েছে যে- মানুষের ভবিষ্যৎ বিপন্ন। মানুষ যদি পরিবেশবান্ধব শিল্প এবং কৃষি উদ্ভাবন করতে না পারে এবং জনসংখ্যা হ্রাস ও সমাজে শোষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারে তাহলে পৃথিবী একদিন বসবাসযোগ্য থাকবে না।
আপনি মহাবিপর্যয়ের কথা বলছেন। এই মুহূর্তে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু কি নেই?
আশাবাদ তো থাকবেই। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ একদিন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। যে সংকট মানুষ সৃষ্টি করেছে তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পথ’ সে খুঁজে পাবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা দেখে খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না। সবসময় একটা বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃতি ধ্বংসের আশঙ্কাও আমরা দেখি। কারণ, পরিবেশবান্ধব শিল্পের বিকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন