মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

বাহারি রঙের কাঠগোলাপ

গ্রীষ্ম কেবল কাঠফাটা রোদ্দুর, তপ্ত হাওয়া আর কালবোশেখীর প্রবল ঝড়ের মৌসুম নয়। বাহারি ফুলের সমারোহে গ্রীষ্ম ঋতু প্রকৃতির রাজ্যে যোগ করেছে ভিন্ন সুষমা। গুচ্ছ গুচ্ছ কাঠগোলাপের বর্ণালি শোভা অন্তত সেটাই মনে করিয়ে দেয়। পাতার ফাঁকে সাদা, লাল, গোলাপি আর হলুদাভ রঙের ছিটায় এটি আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। রৌদ্রপ্রখর দিনে কাঠগোলাপের মিষ্টি সুবাস আর রঙিন পাপড়ি যেন সবার মধ্যে সুখের পরশ বুলিয়ে যায়। এর অনুপম সেীন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

ফুলগুলি যেন কথা
পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার
পুঞ্জিত নীরবতা।

   
রঙের বৈচিত্রের মতো পরিচিতিতেও এটি বহুরূপী। কাঠগোলাপ ছাড়াও গুলাচ, কাঠচাঁপা, গোলকচাঁপা, গৌরচাঁপা, চালতাগোলাপ ইত্যাদি নামে একে ডাকা হয়। কাঠগোলাপের প্রজাতি বহু ও বিচিত্র। সুদূর গুয়াতেমালা, মেক্সিকো থেকে এসে এটি ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের উদ্যানে। দেশের নানা প্রান্তেই এর দেখা মেলে। ঢাকায় সুপরিকল্পিত বীথি না থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে এর বর্ণিল প্রস্ফুটন। জাতীয় জাদুঘর, ব্রিটিশ কাউন্সিল, শিশু একাডেমির বাগান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাঠগোলাপ গাছ দেখা যায়।
শীতে পাতাহীন বৃক্ষ যেন কোনো কুশলী শিল্পীর হাতে গড়া সুনিপুণ ভাস্কর্য। নিঃশব্দে দণ্ডায়মান কাঠগোলাপ-তরু নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন। শীতের পর বসন্তেও পত্র এবং পুষ্পশূন্য কায়ায় এটি ঘুমিয়ে থাকে। চৈত্রের শেষভাগে শুরু হয় নতুন কুঁড়ির জাগরণ। ফুটতে শুরু করে একটি-দু’টি করে ফুল। দেখতে দেখতে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গোটা গাছ। আর ফুলের বাসর রাঙিয়ে হেসে ওঠে সৌম্য সবুজপাতা। ডালের মাথায় থোকা থোকা ফুল যেন মনোলোভা কোনো পুষ্পস্তবক। বিশেষ করে লাল-গোলাপি রঙের ফুলগুলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেখায়। তরু তলে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পথিক দৃষ্টি জুড়িয়ে নেয় একপলক। সঙ্গে মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ উদাস-আকুল করে তোলে পথিকের মন। বাসি ফুলগুলো এক সময় ঝরে পড়ে। তখন গাছতলার ঝরা ফুলের সৌন্দর্যও উপভোগ করার মতো।
কাঠগোলাপ-তরু আকারে মাঝারি, উচ্চতা সাধারণত বারো থেকে ত্রিশ ফুট। নরম, ভঙ্গুর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো-ছিটানো, দুধকষভরা। পাতা কিছুটা বড় ও লম্বা। পাঁচটি ছড়ানো পাপড়ির ফুলগুলো পাঁচ থেকে আট ইঞ্চি চওড়া। পাপড়ির কেন্দ্রে কিছুটা হলদে বা কমলা রঙের ছোঁয়া থাকে। ফুলের পাশাপাশি এর পাতার বিন্যাসের সৌন্দর্যও দৃষ্টি কাড়ে। কাঠগোলাপের বৈজ্ঞানিক নাম 
Plumeria spp. (প্রজাতি অনুসারে রুবরা, অ্যালবা, টিউবারকুলেটা ইত্যাদি নামে পরিচিত)। এ গাছের নানা অংশের ওষুধি ব্যবহার রয়েছে। নারকেল তেলের সঙ্গে এর কষ চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এ ফুল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্রতার উৎস, পূজার উপকরণ। বৌদ্ধরা ভাবে এটি মৃত্যুহীন প্রাণের প্রতীক।   

ঘুম আসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে

আম্মু বলেন পড়রে সোনা
আব্বু বলেন মন দে,
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে। (আল মাহমুদ)
শৈশবে মায়ের মুখে ছড়া শুনে কাঁঠালচাঁপা নামের সাথে প্রথম পরিচয়। ফুলের সঙ্গে পরিচয় আরো পরে। এই গ্রীষ্মে ঘন ঝোঁপে সবুজ পাতার ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের বাগানে হঠাৎ দেখা পেলাম কাঁঠালচাঁপার। লতাময় ঝোঁপের আড়ালে সদ্য ফোটা কাঁঠালচাঁপার উচ্ছ্বাস সত্যিই নজরকাড়া। মিষ্টি হলুদ রঙের কাঁঠালচাঁপা আমাদের সবারই প্রিয় ফুল।
কাঁঠালচাঁপা গ্রীষ্মকালে ফুটতে শুরু করে। ফুল ফোটা অব্যাহত থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। কাঁঠালচাঁপা গাছ দেখতে ঝোঁপ জাতীয়। শক্তলতার বিন্যাস এক সময় ঝোঁপে পরিণত হয়। গাঢ় সবুজ পাতা, পাতার বুনন অত্যন্ত নিবিড়। তাই ফুল ফোটার আগে পাতাময় কাঁঠালচাঁপার ঝাড়ের সৌন্দর্যও দেখার মতো। ফুলের রঙ প্রথমে হালকা সবুজ। প্রস্ফুটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হলদে রঙ ধারণ করতে শুরু করে। পরিপূর্ণ ফুটন্ত ফুলের রঙ উজ্জ্বল হলুদ। ফুল পাতার ফাঁকে বোঁটায় ঝুলে থাকে। কাঁঠালচাঁপা গাছে পাতা এতটাই ঘন যে, ফুল সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও গাঢ় সবুজের কোলে ছোট্ট ফুলের মিষ্টি হলুদ হাসি অপূর্ব, মনোমুগ্ধকর।
কাঁঠালচাঁপা বিখ্যাত এর সুগন্ধের জন্য। পরিপূর্ণ বিকশিত ফুলে ঠিক যেন পাকা কাঁঠালের মধুর ঘ্রাণ। গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়। এমন আকুল করা মিষ্টি ঘ্রাণে উদাস হয় হৃদয়-মন। ছয় পাপড়ির উচ্ছ্বলতা আর মনোলোভা ঘ্রাণের জন্য পুষ্পপ্রেমীদের কাছে তাই কাঁঠালচাঁপার বিপুল জনপ্রিয়তা। অনেক বাগানেই এ গাছের দেখা মেলে। ঢাকায় শাহবাগের কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে বেশ কয়েকটি কাঁঠালচাঁপার গাছ রয়েছে। ফুলের বোঁটা বাঁকা, আঁকশির মতো। ফল গোলাকার, ডালের মাথায় থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। বীজ ও কলমের মাধ্যমে কাঁঠালচাঁপার বংশবিস্তার। ইন্দো-মালয়ী প্রজাতির গাছ এটি।

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

কনকচাঁপার স্নিগ্ধ শোভা

য় ঋতুর বাংলাদেশে প্রতি বছর রূপের অপার ডালি নিয়ে আসে বসন্ত। আর যেসব ফুলের অমল শোভায় বসন্ত উদ্যান নির্মল হেসে ওঠে তার মধ্যে অন্যতম কনকচাঁপা। কনকচাঁপা (Ochna squarrosa) আমাদের কাছে নামে যতটা পরিচিত ততটাই অপরিচিত অবয়বে। কারণ ফুলটি বেশ দুর্লভ। ঢাকায় আছে হাতেগোনা কয়েকটি গাছ।
বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশে একটি কনকচাঁপার গাছ ছিল, এখন নেই। সেই গাছটির চারা এনে শিশু একাডেমীর বাগানে লাগিয়েছিলেন নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ূয়া। আবার শিশু একাডেমীর গাছটির একটি চারা নিজের ঘরে কয়েক বছর সযত্নে লালন করে রমনা পার্কে রোপণ করেছিলেন অধ্যাপক
দ্বিজেন শর্মা। সেই সূত্রে রমনা পার্কের গাছটি বলধা গার্ডেনের গাছটির নাতনি। দ্বিজেন শর্মার লেখা থেকেই জানা যায়_ 'আমার টবে তো ওর ঘরসংসার হবে না, ওকে যথাস্থানে পাঠানো আবশ্যক। ফোন করলাম রমনা পার্কের অফিসে। তারা ঠাঁই দিতে রাজি।...... সবাই মিলে সেরা জায়গাটিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে চারাটি লাগানো হলো।'
কনকচাঁপা আমাদের অতি পুরনো ও প্রিয় ফুল। চমৎকার ও আকর্ষণীয় সৌন্দর্যে এটি নিসর্গের শোভা বৃদ্ধি করে। মূলত পাহাড়ি ফুল হলেও সমতলে দু'চারটি গাছ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শীতের রুক্ষতা অন্য সব গাছের মতো কনকচাঁপাকেও স্পর্শ করে। তখন গাছের সব পাতা ঝরে যায়। পাতাহীন ডালে কেবল শূন্যতার রোদন। বসন্তের শুরুতেই কনকচাঁপা যেন নতুনভাবে জেগে ওঠে। গাছের শাখা-প্রশাখা কচি তামাটে পাতায় ভরে ওঠে। গুচ্ছ গুচ্ছ কচি পাতা দখিনা বাতাসে দোল খায়। সেই সঙ্গে ফুটতে শুরু করে অসংখ্য ফুল। কুঁড়ির রহস্য ভেদ করে নতুন পাতার ফাঁকে ফাঁকে হেসে ওঠে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুলগুলো। সারা গাছ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। কনকচাঁপার পাপড়িগুলো তখন যেন সোনা রঙের দ্যুতি ছড়ায়। তার সঙ্গে মিষ্টি সৌরভ ভেসে বেড়ায় বসন্তের আলুথালু বাতাসে। মধুর লোভে ছুটে বেড়ায় মৌমাছি ভোমরার দল। কনকচাঁপার অপূর্ব রূপ আর সুবাসে মোহিত হয়ে কবিগুরুর মতো আমরাও গেয়ে উঠি_ কনকচাঁপার গন্ধ-ছোঁওয়া বনের অন্ধকারে.........।
থোকায় থোকায় অজস্র ফুল ফুটলেও খুব বেশি দিন থাকে না। বসন্তের সি্নগ্ধ সকালে কনকচাঁপার অপার সৌন্দর্য আমাদের মোহিত করে। বেলা একটু গড়ালেই রৌদ্রতাপে নেতিয়ে পড়ে ফুলগুলো। বিকেলে গাছতলায় বসে ঝরা ফুলের মেলা। কনকচাঁপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে রমনা পার্কে চলে আসুন। পাকের্র নার্সারির খুব কাছাকাছিই রয়েছে গাছটি। তা ছাড়া শিশু একাডেমী বাগানের গাছটিও খুব সহজেই নজর কাড়ে।
কনকচাঁপা মাঝারি ধরনের গাছ। আড়াই মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। ডালপালা কিছুটা ছড়ানো। পাতা লম্ব-ডিম্বাকার, তরঙ্গায়িত। ফুল ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার চওড়া, পাপড়ির সংখ্যা ১২। ফুল ঝরে গেলে লালচে গোলাকার ফল হয়। ফল একক বা গুচ্ছ হতে পারে, যা গাঢ় হলদে বৃত্তাংশ দ্বারা আবৃত। কাঠ শক্ত, লাল-বাদামি রঙের। কলম বা বীজ থেকে চারা করা যায়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ কনকচাঁপার আদিনিবাস। কনকচাঁপার ওষুধি গুণও রয়েছে। এর শেকড় সর্প দংশনের প্রতিষেধক। হজমের সমস্যায় বাকল এবং ক্ষতের চিকিৎসায় পাতার প্রলেপ উপকারে আসে।

সোনালুর সোনালি আলো

গ্রীষ্মের খরতাপে প্রকৃতিতে প্রাণের সজীবতা নিয়ে যেসব ফুল ফোটে তার মধ্যে সোনালু বা সোনাইলের নাম উল্লেখযোগ্য। ঝাড়লণ্ঠনের মতো দীর্ঘ থোকায় হলুদ-সোনালি রঙের সোনালু ফুল চলতি পথে যে কারও নজর কাড়বেই। শীতকালে সোনালুর শাখা-প্রশাখায় সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ভর করে। পুরো গাছে একটি পাতাও থাকে না। বসন্তেও অনেকটা নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ। সোনালুর ঘুম ভাঙে বৈশাখের শুরুতে। তখন দীর্ঘ মঞ্জরির ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে, তার সঙ্গে নতুন পাতার জাগরণ। দেখতে দেখতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় গাছ। পুষ্পিত সোনালু তখন যেন কাঁচা সোনা রঙে আবৃত। ডালপালা ভরে ওঠে কচি সবুজ পাতায়। সোনালুর প্রধান আকর্ষণ দীর্ঘ ঝুলন্ত পুষ্পমঞ্জরি। বৈশাখী হাওয়ার পরশে এর থোকাগুলো দুলতে থাকে, ঠিক যেন কানের দুলের মতো। আর হলুদ বরণ সৌন্দর্য মাতোয়ারা করে রাখে চারপাশ।
সোনালু গাছ আকারে ছোট। ডালপালা ছড়ানো-ছিটানো, নিবিড় নয়। গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলো যৌগিক, মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। ফুল এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া, পাপড়ির
সংখ্যা পাঁচ। ফল গোল, লাঠির মতো লম্বা। এ কারণে সোনালু কোথাও কোথাও বানরলাঠি নামেও পরিচিত। বানরলাঠি ঘিরে লোকসমাজে নানা গল্প প্রচলিত। এ নিয়ে হৈচৈ আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠে গ্রামের উদ্দাম কিশোরের দল। রূপ-প্রাচুর্যে অতুলনীয় সোনালু গ্রামবাংলায় স্বল্পসংখ্যায় চোখে পড়ে। ঢাকায় এ গাছের সংখ্যা খুব বেশি নয়। জানামতে, শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের মাঝখানের রাস্তায় যে একসারি গাছ দেখা যায় তা-ই ঢাকা শহরে সোনালুর সবচেয়ে বড় সমারোহ। এ ছাড়া রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রাঙ্গণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সোনালুর দেখা মেলে।
সোনালুর ফল, ফুল ও পাতা বানরের প্রিয় খাদ্য। এ গাছের কাঠ জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য কাজে লাগে। ফলের বিভিন্ন অংশ বাত, বমি ও রক্তস্রাব প্রতিরোধে উপকারী। বীজ সহজেই অঙ্কুরিত হয়, যদিও বৃদ্ধি মন্থর। সোনালুর আদিবাস পূর্ব এশিয়ায়। বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাশিয়া ফিস্টুলা । ক্যাশিয়া গ্রিক নাম আর ফিস্টুলা অর্থ বাঁশি। ফলের আকৃতির জন্য এমন নামকরণ। সোনালুর ইংরেজি নাম গোল্ডেন শাওয়ার।

অর্কিড কাঞ্চনে মুগ্ধতা

পৌষের এক কুয়াশামোড়ানো সকালে প্রকৃতির একটু সবুজ ছোঁয়া পেতে গিয়েছিলাম রাজধানীর রমনা পার্কে। শীতের চাদর ফুঁড়ে এক চিলতে রোদের ঝিলিক ভারী মিষ্টি ...