আজকাল যেখানেই যাই, সেখানকার গাছপালা চেনার চেষ্টা করি। আর যদি থাকে বৃক্ষের কোনো সাজানো উদ্যান সেই সবুজ সমাবেশে যোগ দেওয়ার সুযোগ হারাতে চাই না কিছুতেই। গত বছর ভাদ্রমাসের এক দুপুরে তাই হাজির হয়েছিলাম সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে। বাড়ির খুব কাছে হলেও চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক এই বৃক্ষসম্ভার ভালোভাবে দেখা হয়নি। কবিগুরুর কবিতার মতোই: দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু। পার্কে ঢুকতেই মিলল নানা রঙের পাতাবাহার, গোলাপ, অলকানন্দা আর সুদীর্ঘ শিমুলবীথির সম্ভাষণ। ফটক অঙ্গনে নীরবে শোভা ছড়াচ্ছে বহু সবুজ বন্ধু। বেশিরভাগই চেনা, ঘরের আঙিনার বৃক্ষ ও গুল্মলতা। মেহগনি, শিরীষ, গগনশিরীষ, জবা, রঙ্গন, কামিনী, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, অর্কচূড়, চালতা ও শিউলির ছায়া পেরিয়ে সামনে পিচঢালা সরু পাহাড়ি পথ। দু’পাশে গাছের সারি। স্বর্ণচাঁপা, কুরচি, শেওড়া, আকাশমণির মহাসমারোহ। আনন্দে আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায় কয়েকটি বুদ্ধ নারিকেল গাছ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৮০৮ হেক্টর জায়গাজুড়ে এই পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। এটি দেশের প্রথম ইকোপার্ক। উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৯ সালে।
পার্কের প্রধান ফটক থেকে ৬ কিলোমিটার ভেতরে ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ মন্দির। সহস্রধারা ও সুপ্তধারার মত প্রবহমান প্রাকৃতিক ঝরনা এর বিশেষ আকর্ষণ। পাহাড়চূড়া থেকে চোখে পড়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। সুউচ্চ সবুজ আর মেঘমালা মিলেমিশে একাকার। যেন পাহাড়ের সঙ্গে আকাশের মধুর মিতালি। আরেকদিকে দূরে নীল সমুদ্রের হাতছানি। কাজী নজরুল ইসলামের গানের ভাষায়: আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই/ ওই পাহাড়ের ঝর্না আমি, ঘরে নাহি রই গো উধাও হয়ে বই। স্বল্পসময়ের পার্ক দর্শনে চোখে পড়েছে তিনটি গোলাপ বাগান। তবে দুটি বাগান নামেই, গাছগুলো কোনোরকমে টিকে আছে। তাতে ফুল নেই, নেই যত্নআত্তির ছাপও। ফুলগাছের চেয়ে আগাছাই বেশি। গোলাপবাগান নয়, এ যেন আগাছার উদ্যান। তার চেয়েও করুণ অবস্থা অর্কিড হাউজের। লোহার কাঠামোই শুধু আছে, অর্কিডের কিছুই নেই। পার্কে কিছু গাছে পরিচিতিমূলক ফলক টানানো রয়েছে। মজার ব্যাপার, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফলকই শুধু আছে, কোনো নাম বোঝার উপায় নেই। কয়েকটি গাছ চিনতে না পেরে ফলক দেখার চেষ্টা করেছি। আমার ভ্রমণসঙ্গী ছোটভাই মুসলিম ফলকের দু’পাশই উল্টে দেখেছে, তবে নাম জানতে পারিনি। লেমিনেটেড সাদা কাগজে লেখা অক্ষর হয়ত বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। আর সাদা কাগজ বুকে নিয়ে বৃক্ষরা বলছে, নাম নয়, ফলে পরিচয়। কিন্তু ফল ধরার যে অনেক দেরি। তাই ফিরে এলাম পরিচয় না জেনেই। অবশ্য প্লাস্টিকের নামফলকগুলো ঠিকঠাক আছে।
এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পার্কে কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য ও অব্যবস্থাপনার চিত্র যেমন চোখে পড়েছে, তেমনি দর্শনার্থীদের আচরণও বেশ পীড়াদায়ক মনে হয়েছে। প্রকৃতির কাছে যাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে, তবে এর সঙ্গে দায়িত্বশীলতার ব্যাপারও যে নিবিড়ভাবে জড়িত; তা বোধ করি অনেকেই মনে রাখেন না। চলতি পথে যেখানে-সেখানে পড়ে আছে খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা আবর্জনা। কোথাও স্তূপও জমেছে। যা দীর্ঘমেয়াদে পার্কের পরিবেশ ও বৃক্ষতরুলতার ক্ষতির কারণ হবে। কয়েকজন তরুণ মোটরসাইকেল নিয়ে মেতেছিলেন গতির প্রতিযোগিতায়। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ হওয়া উচিৎ নীরব ধ্যানের মতো। এ সময় উদ্ভিদ-প্রাণি ও পরিবেশের অনিষ্ট কিছুতেই কাম্য নয়। পার্কের শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: গর্জন, তেলসুর, ডেউয়া, গুটগুটিয়া, বাঁশপাতা, জারুল, পলাশ, ডুমুর, শিমুল, আমলকী, হরীতকী, বহেরা, নিম। আছে বিরল প্রজাতির সাইকাস। জলপাই, সেগুন, জাম, সিভিট, বকুল, সজনে, কাঠবাদাম, অর্জুন, দেবদারু, নাগেশ্বর, ঝাউবীথিরও দেখা মিলবে। বেশ কিছু ঝোপঝাড় জড়িয়ে বাসা বেঁধেছে আসামলতা।
এ পার্ক বানর, হরিণ, খরগোশ, বনমোরগ, শিয়াল, গুইসাপ, গোখরা সাপ, সজারু ইত্যাদি প্রাণির আবাস হলেও এদিন কেবল কাঠবিড়ালি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এখানে আরও আছে: পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পিকনিক স্পট, ক্যাকটাস হাউস, জাতীয় কবির ভাস্কর্য, শাপলাভরা পুকুর ও দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার।
বৈলাম বৃক্ষের খোঁজে
বলে রাখা ভালো, ইকোপার্কে এই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈলাম বৃক্ষের অনুসন্ধান। দেশের সবচেয়ে উঁচু গাছ বৈলাম; তাই এই আগ্রহ। চিরসবুজ এই বৃক্ষ পরিণত বয়সে ২৪০ ফুটের বেশি উঁচু হয়। দীর্ঘবীথির দেখা মিলবে এমন আশা ছিল। ফটক থেকে কিছু দূর যেতেই একটি মাঝারি গাছের দেখা পেলাম। পরে আরও কয়েকটি।
পার্কের বনকর্মীরা জানান, বিভিন্ন জায়গায় বৈলাম চারা লাগানো হলেও বর্তমানে ছয়টি গাছ মাথা তুলে আছে। বৈলাম নিয়ে আগ্রহের কারণ, সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন। ‘বিলুপ্তির পথে বৈলাম বৃক্ষ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মাত্র ২৪টি বৈলাম গাছ টিকে আছে। এই তথ্য যথাযথ নয় বলে জানান গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসাইন। তার ভাষ্য, চট্টগ্রামের হাজারিখিল ও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকার প্রাকৃতিক বনে এখনও প্রায় দেড়শ’ বৈলাম গাছ আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বন ও বাগানে এর চারা লাগানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় তিনশ’ বৈলাম চারা বড় হচ্ছে। বন বিভাগের অধীন বনেও চারা লাগানো হয়েছে। এভাবে বৈলাম গাছ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেটসহ পার্বত্য বনাঞ্চলে গর্জন গাছের পাশাপাশি বৈলামও আছে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন