শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০

গাঁয়ের পথে চলতে চলতে

তরুপল্লবে ঘেরা ছায়াঘন গ্রাম দেখলেই মন বড় উদাস হয়ে ওঠে। ভাবি- এমন কোনো গ্রামে যদি পাকাপাকি থেকে যেতে পারতাম। দু’পাশে শস্যক্ষেত ছাড়িয়ে পথ চলতে চলতে আজও সে-কথাই ভাবছিলাম। কাছে ফলে ভরা শিমুল গাছ চোখে পড়তেই বুকে বেজে উঠল আরেক দুঃখের সুর- বড় ইচ্ছে ছিল; শিমুলে-লাল কোনো বৃক্ষছায়ায় দাঁড়িয়ে একটি বেলা কাটাবার স্মৃতি তুলে রাখব ছবিতে। এদিকে ফাগুন চলে গেল, সেই ইচ্ছেপূরণ হলো না। দুর্গম দ্বীপে এসে পাওয়া বন্ধু রায়হানের সঙ্গে ওই আলাপই করছিলাম: আমার ‘শিমুল ফুলের দুঃখ’ এক বছরের জন্য তোলা থাকল। শিমুল ফুলের দিন ফুরালেও প্রকৃতিতে বসন্তের রেশ কাটেনি এখনও। দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহু সুর ওই বার্তাই দিচ্ছিল।
পৃথিবীজুড়ে এখন চলছে করোনাকাল। বহু দেশ ঘুরে বঙ্গদেশেও এর ঝাপটা এসে লেগেছে তীব্রভাবে। একরকমের ঘরবন্দি দিন কাটিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা থেকে মুক্তি পেতে দু’বন্ধু ঘুরতে বেরোই গোঁয়োপথে। দু’পাশজুড়ে ঘন গাছের সারি, ঝোপ-জঙ্গল, এঁদো পুকুরে জায়গাটা গ্রামই বটে, তবে পথঘাট মোটেও গেঁয়ো নেই। পাকা রাস্তায় কোথাও পিচ, কোথাও ইটবিছানো।
জটিল এই জীবন সংসারে আমার দৃষ্টি বড় বেশি সরল। তাই অন্য কিছু রেখে পথ চলছিলাম গাছ দেখতে দেখতে- মেহগনি, ছাতিম, সন্দ্বীপের বিখ্যাত পুন্যাল (নগর উদ্যানে এর পরিচিতি সুলতানচাঁপা নামে) আর মেঘশিরীষের সারি। আরও কয়েকটি গাছের নাম জানা নেই। রায়হান জানাল, কেঁদা, র’না ইত্যাদি আঞ্চলিক নাম। হলদে ও কমলা রঙের ফুলফোটা আরেক গাছের স্থানীয় নাম বলই।
ছায়াঘেরা পথে একজাতের পোকার অবিরাম সুরেলা শব্দ শ্রবণযন্ত্রে আলোড়ন তুলল। আগেও এর ডাক শুনেছি। রায়হান জানাল, ওটি ঝিঁঝিঁপোকা। গাছের ডালে, পাতার আড়ালে বসে এমন সুরের গুঞ্জন তুলেছে পোকাগুলো, বহু কসরত করে একটির দেখা মিলল। কোনো শব্দ না করেও মুক্ত আকাশে উড়ে মন জুড়াল ফড়িংয়ের দল। যেতে যেতে চোখ রেখেছিলাম পাখিদের দিকেও- শিকারের খোঁজে উড়ন্ত চিল, উঁচু ডালে একটানা ডেকে যাওয়া কোকিল আর কানে এলো কয়েক জাতের শালিকের গান। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে জল ছিটিয়ে খেলছিল জোড়া শালিক। তা দেখে দু’কাঠি সরেস রায়হান তুলল আরেক খেলার প্রসঙ্গ। তার মতে, এটা নাকি পাখিদের প্রজননকাল। ভালোবাসাবাসি শেষে তাই শালিকজোড়া গোসল সারছিল। বাঁশঝাড়ে একটি শাদা বক উড়ে যেতে যেতে গাছের ডালে দেখা মিলল টুনটুনি দম্পতির।
এবার একেবারে কাঁচাপথ, কাঁচা-পাকা ঘর, গরুর গোয়াল, খড়ের গাদা- যেন হাজার বছরের পল্লীগ্রাম। আমার গ্রামবাসী হওয়ার ইচ্ছের গল্প আবার উঠল। বললাম, চাষবাস করে সারাজীবন এমন গ্রামে কাটিয়ে দিতে চাই। যান্ত্রিক নগরে আর ফিরতে মন চায় না। রায়হান তাতে সায় দিয়ে বলল, বিয়ে করে এখানেই থেকে যান। এ সুযোগে সন্দ্বীপে বিয়ের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নানা আলাপ চলল।
ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমে। পথের একপ্রান্তে দেখা পেলাম গাছভর্তি বরুণ ফুলের। এর কয়েকটি ছবি তুললাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে ফিরতি পথে চলতে চলতে ভাবছিলাম অনাগত দিনের ভাবনা। চিরতরে গ্রামে থেকে যাওয়ার চিন্তা প্রায়ই করি। বুঝি, আসলে ওই চাওয়াটা ক্ষণিকের। জীবন সমুদ্রে উদ্দাম ছুটে চলার যে নেশা- দু’দিন পর এই গ্রাম্যজীবন আর ভালো লাগবে না। টানা এক দশক নগরে থাকার ফলে এই সাময়িক গ্রামবাস যাত্রাবিরতির মতো আনন্দের। হয়ত ‘উন্নতি’র স্বপ্নে আবার ছুটব নগরে। জানি, শহরে প্রত্যাবর্তনে তথাকথিত উন্নতির সম্ভাবনা প্রসারিত হবে, কিন্তু আজকের মতো এই নির্মল জীবনানন্দ সেখানে মিলবে না। এদিকে আমার যে, আনন্দ ও উন্নতি দুই-ই চাই।

২৭/০৩/২০২০
সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম।

অর্কিড কাঞ্চনে মুগ্ধতা

পৌষের এক কুয়াশামোড়ানো সকালে প্রকৃতির একটু সবুজ ছোঁয়া পেতে গিয়েছিলাম রাজধানীর রমনা পার্কে। শীতের চাদর ফুঁড়ে এক চিলতে রোদের ঝিলিক ভারী মিষ্টি ...