শনিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১২

বাদল দিনের চালতা ফুল

বাদল দিনের চালতা ফুল 


একপশলা বৃষ্টির পর সতেজ বৃক্ষরাজি দেখার জন্য হাজির হলাম উদ্যানে। মাথার ওপরে তখন ঝলমলে নীলাকাশ। বৃক্ষ-তরুলতায় বৃষ্টি-ধোয়া উচ্ছ্বাস। পাতার কোলে বিন্দু বিন্দু জলের সৌন্দর্য। শান্ত সজীব প্রকৃতির এমন মুহূর্তে চালতা গাছের দিকে তাকাতেই থমকে গেল দৃষ্টি। ঘন সবুজ পাতার কোলে সদ্য ফোটা ফুলের মায়াবী হাসিতে ভরে গেল মন। মুগ্ধ চোখে ফুলের দিকে চেয়ে কেটে গেল নিষ্পলক আরও কিছুক্ষণ। চালতা ফুলের রূপে মোহিত কবি এমন কোনো দিনেই হয়তো লিখেছেন-
আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/
চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে। (বিষ্ণু দে)
চালতা ফুলের কমনীয়তা কদম-কেয়া-মালতীর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। রূপবৈচিত্র্য, সৌকর্যে বাগানের যে কোনো ফুলের সঙ্গে এটি তুলনীয়। কিন্তু আমাদের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চালতা ফুলের মাধুর্য বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। তাই ফল হিসেবেই লোকসমাজে এর যেটুকু পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা।
বর্ষা ঋতুর প্রথম ভাগে চালতা ফুল ফুটতে শুরু করে। আকারে বেশ বড়। দুধসাদা পাঁচটি মোটা পাপড়ি আর হলদে পরাগকেশরের সমাহার বড়ই দৃষ্টিনন্দন। ১৫-২০টি গর্ভকেশর তারার মতো সাজানো। গঠনবৈশিষ্ট্যে এটি ম্যাগনোলিয়ার ঘনিষ্ঠ। রূপসী চালতা ফুল বর্ষার বাতাসে ছড়ায় মৃদু সৌরভ। চিরসবুজ চালতা গাছ আকারে মাঝারি, বাকল লালচে ও মসৃণ। ডালপালা ওপরের দিকে ছড়ানো-ছিটানো। চালতা গাছের পাতার বিন্যাস এবং বৈচিত্র্যও দেখার মতো। টিয়া-সবুজ রঙের পাতা দীর্ঘাকৃতি, সমান্তরাল শিরায় পরিপূর্ণ এবং পাতার কিনার খাঁজকাটা। ফুলের পাপড়ি ঝরে যাওয়ার পর বৃতি একসময় ফলে পরিণত হয়। ফলের রঙ সবুজ, প্রায় গোলাকার, পাতার ফাঁকে বোঁটায় ঝুলে থাকে। শর-হেমন্তে ফল পাকে। ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি বলে আচার-চাটনি-জেলি হিসেবে এটি বেশ উপাদেয় ও মুখরোচক। বিশেষ করে কাঁচা চালতার আচারের স্বাদ মনে এলে যে কারও জিভে জল আসে। চালতার কাঠ শক্ত ও টেকসই। নৌকা ও বন্দুকের বাট তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। বাকল ও পাতা নানা কাজে লাগে। তাছাড়া পেটের পীড়া ও জ্বর নিরাময়েও উপকারী।
আমাদের দেশের সর্বত্র চালতা গাছ দেখা যায়। বাড়ির আঙিনায় কিংবা বনে-জঙ্গলে অনাদরে দু'চারটা গাছ থাকাও বিচিত্র নয়। সুপরিকল্পিত বীথি না থাকলেও ঢাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গাছ চোখে পড়ে। বলধা গার্ডেন, রমনা পার্ক, মুক্তাঙ্গন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চালতা গাছের দেখা মেলে। ভারতবর্ষ চালতার আদি নিবাস। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, শ্রীলংকা, আসাম ও মালয়ে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা, ইংরেজি নাম এলিফ্যান্ট অ্যাপল। ফুল ও ফল ছাড়াও চালতা গাছ বৃক্ষ হিসেবে সৌন্দর্যে অনুপম। তাই শোভা বর্ধনের জন্যও এটি বাগানে লাগানো যেতে পারে।
  (আগস্ট, ২০১২ দৈনিক সমকাল-এ প্রকাশিত) 

বুধবার, ৮ আগস্ট, ২০১২

ইচ্ছের নীল পাখি



ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে আট মিনিট বাকি। এমন সময় সাকিবের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমলাগা চোখে সে পাশের কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখে আব্বু-আম্মু এসেছে কি না। না, আসেনি। দূর থেকে অস্পষ্ট টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয় তো রান্নাঘরে রীনা আপা কাজ করছে। 
সাকিবের বাবা-মা দু’জনই চাকরিজীবী। ব্যাংকার। সকাল একসঙ্গে অফিসে যান আবার একসঙ্গে ফেরেন। তাই রাত আর ছুটির দিন ছাড়া বাবা-মাকে খুব একটা কাছে পায় না সাকিব। ইশ্কুল থেকে ফিরে সাকিবের সারাদিন হয় একা একা, নয় তো মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় রীনার সঙ্গে কাটে।
চারটায় অফিস শেষ করে প্রতিদিন এরই মধ্যে তো আব্বু-আম্মু বাসায় ফেরে। কিন্তু আজ দেরি হচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? নাকি দু’জনে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেছেন কিংবা শপিং করছেন? কিন্তু না, আমাকে ফেলে যাওয়ার তো কথা নয়। তবে হয়েছে টা কী? ভাবনাগুলো দশ-বছর-বয়সী সাকিবের মনে সোনালি ফড়িঙের মতো উড়াউড়ি করে। না, একা-একা বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। রীনা আপা কিচেনে ব্যস্ত। এই ফাঁকে নিঃশব্দে দরজা খুলে পাঁচতলার ছাদে চলে এল সে। ওদের বাসাটা দ্বিতীয় তলায়। উত্তরের জানালা দিয়ে খোলা মাঠ দেখা যায়। ওখানে ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা করে। মাঠটি সবুজ ঘাসে ভরা আর চারপাশে কিছু গাছপালাও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে ওটাকে কিছুটা গ্রামের মতো মনে হয়। সাকিব মাকে অনেক বলেছে ওই মাঠ থেকে একবার  ঘুরিয়ে আনতে। মা নেয়নি, রীনাও নেয় না।
আজ ছাদ থেকে মাঠটিকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সাকিবের মনে আনন্দ আর ধরে না। কাপড় দিয়ে চোখ-বাঁধা একজন অন্যদের ছুঁয়ে দিতে চাইছে আর সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। কেউ বা বল নিয়ে খেলছে, দৌড়াদৌড়ি করছে। আবোল-তাবোল কী যেন বলছে আর ইচ্ছে মতোন ঘুরছে। বাহ, ভারি মজার তো! দৃশ্যগুলো ভীষণ পছন্দ হল সাকিবের। এ রকম খেলা সে আগেও একবার দেখেছে ওর দাদুবাড়ি। গ্রামে এমনি আরো কত কিছু দেখা যায়। তাই গ্রাম খুব ভাল লাগে তার। কিন্তু মা বলে, গ্রাম নাকি একদম পচাঁ। গত ঈদেও গ্রামে গিয়েছিল সাকিব। কিন্তু ওর পরীক্ষা এবং মায়ের শরীর খারাপÑ এই অজুহাতে এবার শহরেই ঈদের ছুটি কাটিয়েছে তারা। হঠাৎ তার গ্রামে চলে যেতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। আর ইচ্ছে করে বস্তির ওই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু মায়ের চোখে পঁচা মাঠের ওই ছেলেদের সাথে কখনও কি সে মিশতে পারবে? ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেছে। সুর্য্যিটাও হারিয়ে গেছে আকাশের কোলে। মাঠখানা ফাঁকা, খেলা শেষে সবাই ফিরে গেছে যে যার ঘরে। চার দিকে নেমে এসেছে অন্ধকার।
এদিকে বাসায় ফিরে সাকিবকে না-পেয়ে বাবা-মার সে কী খোঁজাখুজি! কোথায় গেল ছেলেটা? সামনের দরজাটা খোলা ছিল। কেউ ধরে নিয়ে গেল না তো তাকে। ওপর থেকে নিচ সব তলায় খোঁজা হয়ে গেছে। রীনা তিনবার ছাদ থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু কাউকে দেখেনি। মা কাঁদছেন আর রীনাকে বকছেনÑ তুই আমার ছেলেকে না-দেখে কী করছিলি? পাশের বাসার সব আন্টিরা এসেছে সান্ত¡না দিতে। বাবাও ঘামছেন আর সবখানে ফোন করছেন। কিন্তু সাকিবের কোনো দেখা নেই। হঠাৎ সাকিবের হুঁশ হয়Ñ ছাদে তো বহুক্ষণ হয়ে গেছে। মা এসে ওকে খুঁজছে নিশ্চয়ই। উচ্চকণ্ঠে মা বলে ডেকে সে নিচে নেমে আসে। বাসায় ঢুকে শোরগোল শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়। অনেকগুলো মানুষ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারে না মামণি কাঁদছে কেন? অশ্রুভেজা চোখে মা একনাগাড়ে বলে বলে যায়Ñ বাবা তুই এলি? মাকে ফেলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোকে খুঁজতে খুঁজতে......। আচমকা এতসব প্রশ্ন শুনে চমকে গেলেও সাকিব কিছু বলে না।  সে দৌড়ে এসে চুপচাপ মায়ের বুকে মুখ লুকোয়। মায়ের অশ্রু ছাপিয়ে ওর চোখের কোণে ভেসে ওঠে খানিক আগের ভাবনাগুলো। সে জানে না, তার ইচ্ছের পাখিরা কখনও নীল ডানা মেলে উড়বে কি না!

অর্কিড কাঞ্চনে মুগ্ধতা

পৌষের এক কুয়াশামোড়ানো সকালে প্রকৃতির একটু সবুজ ছোঁয়া পেতে গিয়েছিলাম রাজধানীর রমনা পার্কে। শীতের চাদর ফুঁড়ে এক চিলতে রোদের ঝিলিক ভারী মিষ্টি ...